॥ স্মৃতির সরণি বেয়ে শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন ॥
একদা মির্জা গালিব তাঁর গজলে আক্ষেপোক্তি করেছিলেন Ñ ‘হায় ! অতীতে ফেরার যদি কোনো পথ পেতুম’। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরও বারবার মানসবিহার করেছেন কালিদাসের কালে, তাঁর উক্তি Ñ ‘‘মেঘদূত’-এ যক্ষ কেবল ক্ষণিকের জন্য যক্ষ প্রিয়ার নিকট
থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন, আমরা প্রাচীন ভারতের বিদিশা, শ্রাবন্তী, রেবা, শিব্রানদীতীর, উজ্জয়িনীপুর থেকে চিরতরে নির্বাসিত
হয়েছি’, হার না মানা নাছোড় রবীন্দ্রনাথ কবিতাতেও বলেন Ñ
‘‘আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে
দৈবে হতেম দশম রতড়ব নবরতেড়বর মালে
একটি শোে
ক স্তুতি গেয়ে
রাজার কাছে নিতেম চেয়ে
উজ্জয়িনী নগর প্রান্তে কানন ঘেরা বাড়ি।’’
সশরীরে কোন নর- অতীত দিনের দিকে যেতে না পারলেও স্মৃতির সরণি বেয়ে বা মানসচক্ষে চেয়ে অতীতে Ñ সুদূর
অতীতে যেতে পারেন। চলুন, আরাও শিবপ্রসাদ শিক্ষায়তনে ছায়াঘন দেবদারু বীথীতলে সুস্থির দাঁড়িয়েই আজ হতে শতবর্ষ আগে
চলে যাই।
বিশ শতকের সকালবেলা, আশিরনখ বাংলা মা-এর ধড় মুণ্ড আলাদা করলো ১৯০৫-এ ব্রিটিশ সরকার। কবি লেখকেরা
কবিতা ও গানে গর্জে উঠলেন, বাংলা মা-এর দামাল ছেলেরা প্রতিবাদ করলেন। ১৯১৩ তে বাংলার কবি রবি ঠাকুর নোবেল
পেলেন, ভালো কথা, কিন্তু তার রেশ না কাটতেই ‘দূর হতে শোনা গেল মৃত্যর গর্জন’। য়ুরোপে প্রম মহাযুদ্ধের রণ দামামা বেজে
উঠলো। এদেশ জুড়ে মহাত্মাজীর নেতৃত্বে তখন অসহযোগের উত্তাল ঢেউ Ñ বাঁধ ভাঙা উন্মাদনা। কুমিলার
বীর বিপবী
বসন্ত কুমার
মজুমদার ব্রিটিশের চোখে ধূলো দিয়ে এই হেঁড়িয়া গ্রামে তখন অণ্তরীণ। বসন্ত কুমার জানতেন, শিক্ষাই চেতনা আনতে পারে,
চেতনার উদ্রেক হলে দেশপ্রেম, জাত্যভিমান ও মানবতাবোধ জাগরিত হয়। তাই অনালোকিত হেঁড়িয়ায় শিক্ষার বীজ বপন করতে
তিনি উদ্যোগী হলেন। বসন্ত কুমার মজুমদারের ডাকে সাড়া দিয়ে কল্যাচক গ্রাম নিবাসী সাউ-বংশোদ্ভূত শিক্ষানুরাগী শিবপ্রসাদ সাউ
শিক্ষার আলো জ্বালতে এগিয়ে এলেন। বসন্ত কুমারের প্রেরণায় স্থানীয় কয়েখজনের সহযোগিতায় শিবপ্রসাদ সাউ ১৯১৭ খ্রীঃ ১৫ই
জানুয়ারী একটি ‘উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়’ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে যা হেঁড়িয়া শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন’ নামে পরিচিত হয়।
শিবপ্রসাদ সাউ মহাশয়ের আর্থিক আনুকূল্যে এবং স্থানীয় শিক্ষানুরাগী স্বর্গত গোবিন্দ প্রসাদ গুড়্যা, গোবিন্দ প্রসাদ দাস,
শিবপ্রসাদ দাস, বিμম কিশোর সাউ, ঈশান চন্দ্র দাস, জগদীশ চন্দ্র গুড়্যা, ডাঃ শশীভূষণ সিংহ, ডাঃ শশীভূষণ মানড়বা, শশীভূষণ
গুড়্যা, ঊমেশচন্দ্র প্রধান, নারায়ণ প্রসাদ বারিক প্রমুখ পৃষ্ঠপোষকদের আন্তরিক সহানুভূতি, সাহায্য ও সমবেত প্রচেষ্টায় এই
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯১৭ সালে ১৫ই জানুয়ারীর পবিত্র দিনে এই ইংরাজী বিদ্যালয়টি উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হল এবং
অস্থায়ীভাবে হেঁড়্যা বাজারের স্বর্গত গোবিন্দ প্রসাদ গুড়্যা মহাশয়ের দোকান ঘরগুলিতে বিদ্যালয়ের কাজ চলল। স্বর্গত পঞ্চানন
বারিক ও নারায়ণ প্রসাদ বারিক মহোদয়গণের দোকান ঘরগুলি ছাত্রাবাসে’ পরিণত হল। লাক্ষী গ্রাম নিবাসী শ্রী খগেন্দ্রনাথ বেরা,
(এম.এস.সি. বি.এল.) মহাশয় অবৈতনিক প্রধান শিক্ষকরূপে বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। তখন যৎসামান্য বেতনে
তাঁর সহকর্মীরূপে শিক্ষাদান কার্য্যে ব্রতী হন স্বর্গত উৎপল চরণ বারিক, ঊমেশ চন্দ্র প্রধান, ভূতনাথ কাব্যতীর্থ, কেদারনাথ মাইতি,
ঝাড়েশ্বর মানড়বা, শ্রীমুরারী মোহন বেরা প্রভৃতি ব্যক্তিগণ। প্রম পরিচালক সমিতির সভাপতি হইলেন দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল
মহাশয়ের ভ্রাতা বিপিন চন্দ্র শাসমল মহাশয়।
প্রধান শিক্ষক খগেন্দ্রনাথ বেরা মহাশয় কিছুদিন পর কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হওয়ায় প্রথিতযথা শিক্ষক স্বর্গত
হেমাঙ্গলাল ব্যানার্জী মহাশয় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। বিদ্যালয়ের মঞ্জুরীর জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত
যোগাযোগ চলে। তখন ভাইসচ্যান্সেলার ছিলে ব্গজননীর সুসন্তান পুরুষসিংহ স্যার আশুতোষ। তাঁর অনুগ্রহে, কাঁথির তদানীন্তন
এস.ডি.ও. নিখিল রঞ্জন রায় মহাশয়ের সুপারিশে এবং ইক্ষুপত্রিকা গ্রামনিবাসী স্বর্গত উপেন্দ্রনাথ ভূঞ্যা মহাশয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায়
বিদ্যালয়টি প্রতম অনুমোদন লাভ করে ১৯২০ সালে। তখন জয়ন্ত কুমার দাসগুপ্ত মহাশয় ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের প্রবল ঝড় বয়ে গেল এই নব অঙ্কুরিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর দিয়ে। দেশপ্রাণ
বীরেন্দ্রনাথের আহ্বানে বিদ্যালয়ের অনতিদূরে অনুষ্ঠিত জনসভায় তাঁর উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা শুনে ছাত্রদের দাবী উঠল - জাতীয়
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। বিদ্যালয়টি হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদীদের আঁতুড় ঘর, দেশপ্রেমের অনুশীল সমিতি।
১৯২২ সালে ছাত্রদের বিদ্যালয় হইতে প্রম ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ঘটল। পরীক্ষার ফল হল সন্তোষজনক।
μমোনড়বতির পথে অগ্রসর হল বিদ্যালয়টি। অসম্পূর্ণ গৃহ নির্মাণেল কাজ হল সম্পূর্ণ। প্রধান শিক্ষকরূপে পর পর প্রতিষ্ঠানের সেবা
করে শ্রীচারুচন্দ্র মহান্তি, উপেন্দ্রনাথ করণ, গোরাচাঁদ মাঝি, শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও ক্ষীরোদ চন্দ্র দাস মহোদয়গণ।
১৯২৬ সালে সর্বনাশা কেলেঘাই বন্যায় স্কুল গৃহ দারুণ ক্ষতিগ্রস্থ হল। কাঁচা ইটের দেওয়াল ও বহু সাজসরঞ্জাম ধ্বংস
হল। সাময়িকভাবে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত হল হেঁড়্যা থানা অফিসে। বন্যাজনিত অজন্মা প্রভৃতির জন্য ১৯২৭ সালে নানাদিক দিয়ে
বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠল অন্ধকারাচ্ছনড়ব। গৃহনির্মাণ ও আসবাবপত্রাদি নির্মাণে প্রয়োজন হল প্রচুর অর্থের। এই দুর্দিনে
সম্পাদক মহাশয় দেশবাসী জনসাধারণের নিকট সাহায্যের আবেদন জানালেন। যাঁরা এই ভূ-সম্পত্তি দান করে দেশবাসীকে
চিরকৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করেছেন তাঁরা হলেন Ñ স্বর্গত শিবপ্রসাদ সাউ ও তাঁর ভ্রাতা স্বর্গত বিμম কিশোর সাউ (১৮ একর ৪৪
ডেঃ), স্বর্গত জগদীশ চন্দ্র গুড়্যা ও তাঁহার ভ্রাতা যতীন্দ্রনাথ গুড়্যা (২ একর ৬৫ ডেঃ), স্বর্গত ঈশান চন্দ্র দাস, অধর চন্দ্র দাস ও
বিপিন বিহারী দাস (১ একর ৯ ডেঃ), স্বর্গত শশীভূষণ মানড়বা (৪৮ ডেঃ), স্বর্গত রামকৃষ্ণ সিংহ (১ একর ৩৩ ডেঃ), ব্রহ্মময়ী দাসী
(৪৪ ডেঃ), স্বর্গত ঊমেশ চন্দ্র প্রদান (২৭ ডেঃ), স্বর্গত নারায়ণ প্রসাদ বারিক (৫৪ ডেঃ), স্বর্গত পঞ্চানন বারিক (৫৪ ডেঃ), অশ্বিনী
কুমার বারিক (৫৪ ডেঃ), মন্মথ কুমার পণ্ডা (১৩.৫ ডেঃ)। উপযুক্ত দলিলের মাধ্যমে উক্ত ভূসম্পত্তি দান করে মহান দাতারা
বিদ্যালয়ের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
১৯২৯ সালে আবার দেখা দিল বিপর্যয়। হঠাৎ ভস্মীভূত হল খড়ের চাল বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের অর্দ্ধেক অংশ। এর পর জনৈক
প্রাক্তন ছাত্র শ্রীগিরিধারী মহাপাত্র মহাশয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরূপে কার্য্যভার গ্রহণ করেন। বিদ্যালয়ের সর্বাঙ্গীন উনড়বতিকল্পে
তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা স্মরণীয়। ১৯২৯ সালের জুলাই মাসে শ্রী যতীন্দ্রনাথ জানা মহাশয় প্রধান শিক্ষকরূপে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
যথীনবাবুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, পরিচালন ক্ষমতা, শিক্ষাদান, উদ্ভাবনী শক্তি ও চারিত্রিক বৈমিষ্ট্য বিদ্যালয়ে সজীবতা আনল।
১৯৩০ সালে আবার বিদ্যালয়কে কঠোর অগিড়বপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হল। তখন ভারতে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু
হয়েছে। তার প্রচণ্ড আঘাত লাগল বিদ্যালয়ের উপর। চারদিকে পুলিশের অকথ্য অত্যাচার। আইন অমান্য আন্দোলনের বিশিষ্ট
নেতা অনুমান করে পুলিশের লাঞ্ছনা, শারীরিক পীড়ন প্রভৃতি চলল যতীনবাবু ও সহকারী শিক্ষক গোপাল বক্সী মহাশয়গণের উপর।
তবুও কোন বিপর্য্যয়ের সম্মুখে বিদ্যালয় নতি স্বীকার করেনি। প্রধান শিক্ষক যতীনবাবু পদত্যাগ করায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন শ্রী
বঙ্কিমচন্দ্র দাস মহাশয়। তবে ছাত্রসংখ্যা μমশঃ হ্রাস পেল। স্কুলের ছাত্র সংখ্যা হ্রাস ও আর্থিক সংকটের জন্য শিক্ষা বিভাগের
কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের মঞ্জুরী প্রত্যাহার করতে চাইলেন। তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাই-চ্যান্সেলার পুরুষ সিংহ স্যার আশুতোষ
মুখোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পুত্র শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ডাঃ শ্যামাপ্রসাদের অনুগ্রহে বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান হিতৈষী
অশ্বিনী কুমার বারিক ও বিμামনগর গ্রাম নিবাসী স্বর্গত কামদেবচন্দ্র বাগ মহাশয়ের আন্তরিক যতড়ব ও চেষ্টায় বিদ্যালয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের
মঞ্জুরী লাভ করতে সক্ষম হল।
ভূতপূর্ব সম্পাদক শিবপ্রসাদের সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র সাউ মহাশয় সম্পাদকের পদ গ্রহণ করে পিতার আরব্ধ
গুরুদায়িত্ব পালন করেন। কিছুকাল পরে প্রাক্তন কৃতি ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র প্রামাণিক মহাশয় প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন। প্রাক্তন ছাত্র
হিসাবে তিনি হলেন দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক। তাঁর নবোদ্যম ও কর্মকুশলতার ফলে অল্প সময়ের মধ্যে বিধ্যালয়টি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দাবানলের উত্তাপে সকলে তখন অসহিষ্ণু। প্রতিষ্ঠানটি তখন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। সেই
সময় সুদক্ষ, অভিজ্ঞ প্রধান শিক্ষক সর্বেশ্বর শাসমল মহাশয় প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করে বিদ্যালয়টিকে সুগঠিত ও আত্মনির্ভরশীল
করে তুলতে সাহায্য করেন। ইতিহাস প্রসিদ্ধ ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে এই অঞ্চল দিল এক অভূতপূর্ব সাড়া। শুরু
হল ধর্মঘট, পুলিশের ধরপাকড় ও অত্যাচার। আন্দোলনে বিদ্যালয়ের কিছু আসবাবপত্র ও সাজসরঞ্জাম ধ্বংস হল। প্রকৃতির নির্মম
খেয়ালের নিকট মানুষকে হার মানতে হল। ১৯৪২ সালের সর্ব্বধ্বংসী সাইক্লোন ও পাবন
নিশ্চিহ্ন করে দিল এতদিনের সাধনালব্ধ
বাণীমন্দিরটিকে। সেই সময় সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র বাবু রিলিফ এডুকেশন অফিসার রায়বাহাদুর পি.সি. মুখার্জীকে বাড়ীতে আমন্ত্রণ
করে প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস ¯তূপ তাঁকে দেখান। তাঁরই অনুগ্রহে বিদ্যালয় সরকার হতে চার হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য পায়। তদানীন্ত
ন হেঁড়্যার এ্যাসিসট্যান্ট রিলিফ অফিসার রহমন সাহেব এবং খাসমহল সাব্-ম্যানেজার এন্. আহম্মেদ গৃহনির্মাণাদি কার্য্যে যথেষ্ট
সহানুভূতি দেখান। বিদ্যালয়টিকে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল করার উদ্দেশ্যে সম্পাদক ঈশ্বরবাবুর অকৃত্রিম শুভেচ্ছার অন্তরালে নিরবিচ্ছিনড়ব
আকাঙ্খা জাগ্রত ছিল।
১৯৪৯ সালের ফেব্র“য়ারী মাস। পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ্যপাল স্বর্গত ডঃ কৈলাসনাথ কাটজু মহাশয়ের মেদিনীপুর
সফরকালে প্রতিষ্ঠাতার পুত্রদ্বয় ঈশ্বরচন্দ্র ও বলরাম সাউ মহাশয়গণ রাজ্যপালকে নিজ বাড়ীতে আহ্বান করে প্রায় দুই লক্ষ টাকা
মূল্যের অধিক ভূসম্পত্তি ট্রাষ্ট ডীডের মাধ্যমে অর্পণ করেন। তারপরে দেশে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সরকারী সাহায্যের
জন্য আবেদন করা হল। মেদিনীপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা নিকুঞ্জবিহারী মাইতি ও স্বর্গত ঈশ্বরচন্দ্র মাল মহাশয়গণের আন্তরিক
প্রচেস্ঠায় গ্রান্ট-ইন-এড্ মঞ্জুর হয়। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন পীতাম্বর দাস। ১৯৫০ সালের জানুয়ারী মাসে এক
ভয়াবহ অগিড়বদাহে ভস্মীভূত হল বিদ্যালয় গৃহটি। কোন আসবাবপত্র, রেকর্ড ও সাজসরঞ্জাম রক্ষা পেল না। সে ঘটনা এখনও
রহস্যের অন্ধকারে।
সম্পাদক ঈশ্বরবাবু ও স্বর্গত অমূল্যবাবু আর্থিক সাহায্য লাভের আশায় ডি.পি.আই. অফিসে যান। সেই সময় প্রহ্লাদ কুমার
প্রামাণিক ও প্রফুলচন্দ
্র সেন মহাশয়গণের আন্তরিক চেষ্টায় ও সহানুভূতিতে বিদ্যালয় বার হাজার একশত বিরাশী টাকা সরকারী
সাহায্য লাভ করে। সরকারী সাহায্য, দাতাগণ প্রদত্ত সাবেক জমির আয় ও ট্রাস্টবোর্ডের টাকা হতে, কয়েকটি টিনের ঘর ও চারটি
পাকা ঘর নির্মিত হয়। এই গৃহনির্র্মা পীতাম্বর বাবু ও স্বর্গত ঈশ্বরচন্দ্র মাল মহাশয়ের নিরলস কর্তব্যনিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম সত্যই
প্রশংসনীয়।
১৯৫৭ সালের প্রমে কেদারবাবুর পদত্যাগের পর এক সন্ধিক্ষণে বিদ্যালয়ের পুনর্গঠন ও শিক্ষাক্ষেত্রে মুদালয়ার কমিশনের
সুপারিশ অনুযায়ী নয়া পরিকল্পনাকে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে কার্ত্তিক চন্দ্র মানড়বা মহাশয় প্রধান শিক্ষকরূপে কার্য্যভার গ্রহণ করে
যোগ্যতা ও কৃতিত্বের সহিত গুরুদায়িত্ব পালন করেন। প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে তিনি হইলেন তৃতীয় প্রধান শিক্ষক। এই সময়ে
বিদ্যালয়ের নব রূপায়ণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠাতার পুত্রদ্বয় ঈশ্বরবাবু ও বলরামবাবু এবং ভ্রাতুষ্পুত্র জগদীশ বাবু তিনজনে মোট তিন
হাজার টাকা এবং ট্রাষ্টবোর্ড হতে দুই হাজার টাকা মোট পাঁচ হাজার টাকা তদানীন্তন খাদ্যমন্ত্রী প্রফুলচন্দ
্র সেন মহাশয়ের মাধ্যমে
মুখ্যমন্ত্রী স্বর্গত ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় মহাশয়ের হাতে অর্পন করেন। কলা ও কৃষি বিষয় সহ বিদ্যালয়টি সরকারী সাহায্যে বহুমুখী
বিদ্যালয়ে উনড়বীত হয়। অতঃপর মাননীয় প্রফুলচন্দ
্র সেন মহাশয়ের বিশেষ চেষ্টায় ১৯৬২ সালে বিজ্ঞান বিসয়ে অনুমোদন লাভ
করে। সে সময় আনন্দভবন, কৃষি, কলা ও বিজ্ঞান ভবনাদি নির্মান এবং বিজ্ঞানাগারের যন্ত্রপাতি ও আসবাব পত্রাদি μয়ের উদ্দেশ্য
পশ্চিমবঙ্গ সরকার হতে দুই লক্ষাধিক টাকার আর্থিক সাহায্য পাওয়া গিয়েছে।
প্রধান শিক্ষক শ্রীকার্ত্তিক চন্দ্র মানড়বা মহাশয়ের অবসর গ্রহণের পর এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র শ্রী পৃথ্বিরাজ প্রধান মহাশয়
প্রধান শিক্ষক রূপে যোগদান করেন। বজ্রকঠিন অথচ কুসুমকোমল মানুষটি শিরদাঁড়া খাড়া করে মাটিতে পা রেখেই হাঁটতেন। যথার্থ
পণ্ডিত তাঁকে বললে অত্যুক্তি হয় না। প্রধান শিক্ষক শ্রী পৃথ্বিরাজ প্রধান মহাশয় অবসর গ্রহণের পর এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র শ্রীযুত
নীলেন্দু বাগ মহাশয় প্রধান শিক্ষকের আসনে আসীন হয়েছেন।
বিদ্যালয়ে দুটি ক্যাম্পাস Ñ হেঁড়িয়া মাধাখালী রাস্তার দুপাশে শোভিত হয়, মূল ক্যাম্পাসে শ্রেণি কক্ষ ও পাঠাগার বর্তমান।
দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে আছে ছাত্রাবাস ও বিক্ষণাগার। বিদ্যালয়ের সামনে একটি বিশাল খেলার মাঠ অবস্থিত। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়ের মূল
ক্যাম্পাসে একধারে দ্বিতল আরেকটি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। বৃত্তিমূলক বিভাগের জন্য উপযুক্ত শ্রেণি কম, বিক্ষণাগার ও খেলার
মাঠও আছে। ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সহশিক্ষা (কো-এডুকেশান) চালু হয়েছে। বিদ্যালয়টি খেজুরীর অন্যতম
প্রাচীন শিক্ষালয়। এখনও এখানে শিক্ষার আলো জাজ্জ্বল্যমান।
‘‘অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময় ... উপনিষদ।
(অনুলেখন Ñ রাজর্ষি পট্টনায়ক, সহায়তায় মহাদেব প্রসাদ সাউ, জগদীশচন্দ্র ভূঞ্যা, বীরেন্দ্রনাথ সাউ)